জসিম উদ্দিন কাজল
মাদকাসক্তি চিকিৎসা একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ রাখা সম্ভব এই স্লোগানকে সামনে রেখে শহরের প্রান কেন্দ্রে আলী জাঁহাল ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পূর্নবাসন কেন্দ্র।
২৪ জুলাই দুপুরে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসা হেলাল উদ্দিন ৯০ দিনের প্রশিক্ষন শেষে হেলাল উদ্দিনের গ্রেজুয়েশন ও বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সমাজসেবক, মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় দৈনিক আমাদের বাংলা পত্রিকার কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি শহিদুল করিম শহিদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সোহেল সুলতান, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ ও মোহাম্মদ ইদ্রিস।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফিউচার লাইফের পরিচালক ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গ কলকাতা থেকে সম্মাননা অর্জনকারী জসিম উদ্দিন কাজল।
মাদকাসক্ত যুবকদের উদ্দ্যেশ্য প্রধান অতিথি বলেন, মাদকাসক্ত যুবকের অসহায় মুখ সত্যি কষ্টদায়ক, জীবন একটাই, সুন্দর সুস্থ জীবনই আমাদের সম্পদ, মাদক থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
মাদকাসক্তদের উদ্যেশ্যে দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রধান অতিথি আরো বলেন, শহরের নাম প্রকাশ না করার শর্তে সদরের ঝিলংজার এক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্র ছদ্ম নাম নুরুল কবির সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার ইয়াবা সেবনের পাশাপাশি ধূমপানের নেশায় আসক্তি ছিল।
কিন্তু, এখন ঘুম থেকে উঠেই নূরুল কবির এক গ্লাস শরবত পান করেন। যাতে থাকে পুষ্টিকর ফলের রস। বাবা ও মায়ের একমাত্র সন্তান সুঠাম দেহের এই তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার ছলে নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
ছন্নছাড়া জীবন হয়ে যায় তার।
বাবা ও মা কঠিন এক দুশ্চিন্তার সাগরে নিপতিত হয়।
অনেক শাসন ও নিষেধের পরও তাকে এই সর্বগ্রাসী নেশা থেকে বিরত রাখা যায়নি।
এমতাবস্থায় প্রিয় মা বাবা বড় অসহায়।
মাদকাসক্ত কবিরকে সুস্থ করার জন্য ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি পূর্নবাসন কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়।
সেখানে ২৪ ঘণ্টা তাকে চিকিৎসক ও কর্মচারীরা পর্যবেক্ষণে রাখেন।
বলা যায় তার এখন একপ্রকারের বন্দি জীবন।
চিকিৎসকের ওষুধের থেরাপি ছাড়াও তাকে মানসিকভাবে শক্তি দেয়ার জন্য নিয়মিত ‘কাউন্সিলিং’ করা হয়।
এই অবস্থায় নূরুল কবির ভবিষ্যত চিন্তায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তার বাবা- মা।
মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চিকিৎসা শেষে সেই পুরনো কবির তাদের বুকে ফিরে আসবে এই আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন তার বাবা মা।
এ বিষয়ে ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূর্নবাসন কেন্দ্রেরের পরিচালক জসিম উদ্দিন কাজল তার বক্তব্যে বলেন
অত্র প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন রোগী ভর্তি আছেন। ভর্তিরত রোগীর মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী। বাকিরা অন্য পেশায় নিয়োজিত।
একজন মাদকাসক্ত রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূর্নবাসন কেন্দ্র। মাদকাসক্ত রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য ওষুধ সেবন করানোর পাশাপাশি প্রত্যেকের জন্য আলাদা ও গ্রুপ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা আছে।
তাদের এমবিবিএস চিকিৎসকসহ একটি কাউন্সিলিং বোর্ড রয়েছে।
ভর্তিরত রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পূর্নবাসন কেন্দ্রে ভর্তিরত একজন রোগীকে ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
প্রতিদিন সকাল ৬ টার দিকে তাদের ঘুম থেকে উঠানো হয়।
কর্মচারীরা সর্বক্ষণ তাদের অনুসরণ করেন। এরপর তাদের সকাল ৮টার সময় নাস্তা দেয়া হয়। নাস্তা শেষে রোগীদের পাঠানো হয় স্টাডী রুমে। তারা সেখানে ডেইলি পত্রিকাসহ বিভিন্ন বই পড়েন। কেউ আবার টেলিভিশন দেখেন। বেলা ১১টায় তারা আবার চলে যান নিজ নিজ বেডে। সেখানে চিকিৎসকরা প্রত্যেকটি বেডে রাউন্ড দেন। টানা সময় নিয়ে মাদকাসক্ত রোগীর সর্বশেষ অবস্থা জানতে চান।
চিকিৎসক রোগীর ওষুধ সেবনের বিষয়টি জানতে চান।
সূত্র জানায়, দুপুর ১২ টার পর তারা বিশ্রাম নেন। দুপুর ১ টার দিকে তারা গোসল করেন। গোসলের পর তারা নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করেন।
প্রার্থনা শেষে তাদের দুপুরের খাবার দেয়া হয়। খাবারে তিন বেলায় পুষ্টিকর সবজি রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। দুপুরের খাবারের পর তারা আবার বিশ্রামে চলে যান। বিকাল ৪ টার দিকে তাদের জন্য একক বা গ্রুপ কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা হয়। কাউন্সিলিং এর পাশাপাশি কাউকে যোগ ব্যায়াম করানো হয়। কাউন্সিলিংয়ে জীবনের মূল্য, নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও জীবনের শেষ গন্তব্যের পথ দেখানো হয়। পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অবগত করা হয়।
সন্ধ্যার পর ২০ মিনিট তাদের ধর্মীয় বয়ান দেয়া হয়। এরপার আবার তারা নিজ নিজ বেডে চলে যান। তখন তাদের হালকা নাস্তা দেয়া হয়।
ঠিক রাত ৮ বাজলেই আবার চিকিৎসক প্রত্যেকটি বেডে রাউন্ড দেন।
রাত পৌঁনে ৯ টার দিকে তাদের রাতের খাবার দেয়া হয়। খাবারের পর তারা ওষুধ সেবন করেন। রাত ১০ থেকে ১১ টা পর্যন্ত তাদের বিনোদনের জন্য টেলিভিশন দেখতে দেয়া হয়।
তবে মাদকসেবীরা নিজেরা পছন্দ অনুযায়ী চ্যানেল দেখতে পারেন না।
কর্তৃপক্ষ তাদের শিক্ষামূলক চ্যানেল দেখতে দেন। যাতে তাদের জীবনাবোধের শক্তি বাড়ে।
রাত ১১ টা হলে তারা আবার নিজ বেডে ঘুমানোর জন্য চলে যান। এ সময় ঘুমানোর জন্য নিরাময় কেন্দ্রের বাতি বন্ধ করে দেয়া হয়।
একজন রোগী ৯০ দিনের কার্যসূচিতে এভাবেই সময় পার করে সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে উঠেন।
তাদের স্বজনরা আশায় বসে থাকেন, আবার হয়তো সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে তিনি ফিরে আসবেন।
নিরাময় কেন্দ্রে দিনের কার্যসূচিতে যাতে কোনরকম হেরফের না হয় এজন্য কর্মকর্তারা তৎপর থাকেন।
কোন রোগী দিনের নিয়মিত কাজে অলসতা করলে তাকে অনেক বুঝিয়ে ও ভালোবাসা দিয়ে রুটিন অনুযায়ী চলার পরামর্শ দেন।
জানা গেছে, ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে একটি বড় সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় কর্তৃপক্ষকে।
তা হচ্ছে- ভর্তিরত অনেক মাদকসেবী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু,সেখানে কর্মকর্তারা তাদের সর্বক্ষণ নজরদারির কারণে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন না। মূল গেটে ২৪ ঘণ্টা একজন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করেন।
তার হাতে একটি চাবি থাকে। ঢোকা ও বের হওয়ার ক্ষেত্রে তার জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয়। তবে, যেসব রোগীর পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তাদের বেশি করে কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা হয়।
এ বিষয়ে জেলা মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের পরিচালক সুমেন মন্ডল জানান, ফিউচার লাইফ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পূর্নবাসন কেন্দ্রে একজন মাদকাসক্ত রোগীকে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখতে ভালো ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে যে কাউন্সিলিং করা হয় তাতে রোগী জীবনের ছন্দ খুঁজে পায়।
মন্তব্য করুন