সুজাউদ্দিন রুবেল.
নানা সমস্যায় দিন দিন কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোতে কমছে চিংড়ির পোনা উৎপাদন। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে হোয়াইট গোল্ড বা সাদা সোনাখ্যাত এ খাতের রপ্তানি আয়ও। হ্যাচারি সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারের উদাসীনতা, চোরাইপথে রুগ্ন পোনা অনুপ্রবেশ, সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাবে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে চিংড়ি শিল্প। তবে চিংড়ি রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষে পোণা উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি ও আলাদা চিংড়ি চাষ জোন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা।
দেশে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফস্থ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ৫৫টির বেশি চিংড়ি পোনা হ্যাচারি। এখান থেকে প্রতিবছর ১৫’শো কোটির বেশি উৎপাদিত চিংড়ি পোণা চাষের জন্য সরবরাহ করা হতো খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট, চকরিয়া ও মহেশখালীতে।
কিন্তু নানা সমস্যায় দিন দিন কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোতে কমছে চিংড়ি পোনা উৎপাদন। তবে বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে ৩০টি হ্যাচারি। যাতে উৎপাদন হচ্ছে সাত’শো কোটি পোনা। হ্যাচারি সংশ্লিষ্টদের দাবি; সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ ঘোষণা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব, চোরাইপথে রুগ্ন পোণা অনুপ্রবেশ ও সরকারি উদাসীনতায় পোনা উৎপাদন কমছে। যে কারণে ধারাবাহিকভাবে কমছে চিংড়ি রপ্তানিও।
কোয়ালিটি হ্যাচারির ম্যানেজার সাগর আহমেদ বলেন, এখন চিংড়ি পোনা উৎপাদনের মূল মৌসুম। কিন্তু সাগরে ৬৫ দিন মাছ বন্ধ ধরা রয়েছে। যার কারণে মাদার চিংড়ি আহরণ করতে না পারায় চিংড়ি পোনা উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এই ৬৫ দিনে দুটি সার্কেলে মোট ১৬ কোটি পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হত। কিন্তু এখন তা হচ্ছে না। ফলে দুই কোটি টাকার অধিক লোকসান হচ্ছে তাদের হ্যাচারিতে।
বেঙ্গল বে হ্যাচারির সাইফুল ইসলাম বলেন, চাষীদের চাহিদা অনুযায়ী পোনা সরবরাহ করতে পারছি না। ফলে কক্সবাজার উপকূল ছাড়াও সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোরে বর্তমানে চিংড়ি পোনা সরবরাহ করতে না পারায় চিংড়ি চাষীরা বেকায়দায় রয়েছে।
বলাকা হ্যাচারির মোহাম্মদ রুবেল বলেন, কক্সবাজার থেকে গুনগত চিংড়ি পোনা সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর ও বাগেরহাটে সরবরাহ করতে না পারায় চাষীরা চোরাইপথে ভারত থেকে রুগ্ন পোনা সরবরাহ করছে। ফলে চাষীরা বাধ্য হয়ে ঘেরে এই চিংড়ি পোণা ছাড়ছে। এতে চিংড়ি ঘের গুলোতে রুগ্ন পোনা ছাড়ায় অনেক চিংড়ি মারা যাচ্ছে। ফলে দেশে চিংড়ি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে চিংড়ি রপ্তানিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ দিন দিন বাংলাদেশ চিংড়ি রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন সামুদ্রিক মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
সামুদ্রিক মৎস্য বিশেষজ্ঞ সামশুল হাদী খান বলেন, প্রতিবছরই চিংড়ি থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে আসছে। যেহেতু আমাদের চিংড়ি পোণা উৎপাদন কমে গেছে সেহেতু রপ্তানিও কম। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ যারা ২০০৬-০৭ সালে ১ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি করতো; সেখানে তারা এখন রপ্তানি করছে ৬ লাখ মেট্রিক টন। শুধুমাত্র সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা ও সরকারের পরিকল্পনার কারণে তাদের চিংড়ি খাত দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “সরকারের উদাসীনতা, পরিকল্পনার অভাব ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব দিন দিন চিংড়ি রপ্তানি কমে যাচ্ছে। তাই এখনি এই খাতকে রক্ষার্থে সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তাহলে চিংড়ি রপ্তানি বৃদ্ধি করা যাবে।”
তবে চিংড়ি রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে পোনা উৎপাদনে উন্নত প্রযুক্তি ও আলাদা চিংড়ি চাষ জোন করার পরিকল্পনা করছে সরকার।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার মৎস্য অধিদপ্তরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এসএম খালেকুজ্জামান জানান, চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলাদা চিংড়ি চাষ জোন করা হচ্ছে। আগামী বছর থেকে এই চিংড়ি চাষ জোন হবার পর কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনে আনা হবে। এতে মাদার চিংড়ি পোণা, পোণা চিংড়ি এবং চিংড়ি পোনা আহরন সম্ভব হবে। এই এসপিএফ পোনা দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে পারলেই চিংড়ির উৎপাদন অনেকাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ৪৭ হাজার ৬শ ৩৫ মেট্রিক টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। ওই অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৫৫ কোটি ডলার। এরপর ধারাবাহিকভাবে কমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ১শ ৬৮ মেট্রিক টন ও আয় হয় ৪০ কোটি ৮৭ লাখ ডলা
মন্তব্য করুন